আজকের বিশ্ব বিরামহীন গুঞ্জনে মুখরিত, সদা সক্রিয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিনোদন জগৎ, প্রযুক্তি এবং আরও হাজারো উন্নয়ন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য নিরন্তর প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। মুশকিলের কথা হলো, এসব আসলে আমাদের হৃদয়গুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার নিদারুণ প্রতিযোগিতায় মেতেছে। মুক্তবাজারের অবাধ চর্চার সঙ্গে আমরাও প্রতিনিয়ত ভোগের জন্য উৎসাহিত হচ্ছি। সূরা আত-তাকাসুরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বর্ণিত 'প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের ভুলিয়ে রেখেছে', আর কখনো এমন বাস্তব হয়ে ধরা দেয়নি। এমন একটি সময়ে আমরা পদার্পণ করেছি, যখন আল্লাহর প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কাজটিও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করা হচ্ছে-যার অন্যতম প্রমাণ হলো বিনোদন মাধ্যম; আধুনিকতার নামে যা আমাদের ওপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে।
শুধু এখানেই শেষ নয়; আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তিসত্তাকেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভোক্তায় পরিণত করা হয়। আমাদের দ্বীনও এই ব্যবস্থাপনার প্রভাবে একধরনের বিনোদনধর্মী পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের দ্বীনি জ্ঞানে জ্ঞানী স্কলাররাও সেখানে বিখ্যাত তারকা হয়ে উঠছেন। আমরা তাঁদের দেখে বিশ্বাসে উজ্জীবিত হই, তারপর আবার ফিরে যাই আমাদের রুটিনবাঁধা ভোগবাদী জীবনে। মুসলিম জাতি তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে এক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। তাদের বৈশ্বিক ভাবমর্যাদা ছিনতাই হয়ে গেছে কিছু হিংসাত্মক গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে। এই গোষ্ঠী তরুণদের আকৃষ্ট করে, যারা নিজেদের দ্বীনকে ভালোমতো জানে না। সংবাদের শিরোনাম কাঁপানো কাজে নিজেদের আধিপত্য দেখানোই তাদের কাছে মর্যাদার কাজ হয়ে গেছে।
এই উন্মত্ততা আর সংকট এখন এমন পর্যায়ে যে, বিশ্বাসের দিক থেকে এককেন্দ্রিক থাকা এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের সমাজ আর মসজিদগুলো আধ্যাত্মিক নির্দেশনা আর পরামর্শ আদান-প্রদানের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার প্রয়োজন ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন 'আদ-দ্বীন আন- নাসিহাহ'-অর্থাৎ দ্বীন হলো ভালো পরামর্শ দেওয়া। সত্যি এটাই, এখন আমাদের মনও হয়ে গেছে বিক্ষিপ্ত, উদ্ভ্রান্ত। সুতরাং এই সময়ে যখন নেতিবাচক কথা ও কর্মের চর্চা ব্যাপকভাবে হচ্ছে, তখন ভালো এবং গঠনমূলক কথার প্রয়োজন আরও বেশি-যাতে আমাদের ঈমান সুন্দর থাকে, অটুট থাকে।
এই টালমাটাল সময়ে উস্তাদ নোমান আলী খানের ভালো কথাগুলোর সংকলন তরুণদের চিন্তাজগৎকে নাড়িয়ে দেবে। তিনি আমাদের হৃদয়ের ভাষায় কথা বলেন। তাঁর কথামালা আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালনে আমাদের উৎসাহিত করে, আমাদের জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সমসাময়িক সংস্কৃতি যখন আমাদের বলে-'নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও এবং ভোগ করো, মৃত্যু হলো সবকিছুর শেষ।' তখন আমাদের দ্বীন শেখায়-'মৃত্যু হলো আমাদের সত্যিকার জীবনের শুরু।'
এই সংকলনের মূল বিষয় হলো-জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য খুঁজে ফেরা। লেখক স্মরণ করিয়ে দিতে চান, আমরা যেন বাস্তবতার সঠিক ধারণাটি ভুলে না যাই। এই পৃথিবীতে আমাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এই ছোট্ট জীবনটিই একটি ছোট্ট সুযোগের জানালা খুলে দেয়। উত্তম কাজ করার মাধ্যমে সে জানালা দিয়ে অনন্ত জীবনের সবুজ মাঠে প্রবেশ করা যায়। আমাদের এসব কাজের ভিত্তিতেই আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেবেন, পরবর্তী জীবনে আমরা জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত কি না। লেখক একদম ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে বৈশ্বিক জীবনাচরণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন পাঁচটি ভাগে। প্রতিটি ভাগে দুই-তিনটি উপদেশ স্মরণ করে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনের গভীরে প্রোথিত আচরণ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন, গল্প করেছেন। ইবাদতের সময় কীভাবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, চারপাশের মানুষের সম্পর্কে কেন খারাপ চিন্তা করা অনুচিত ইত্যাদি যেমন আলোচনা করেছেন, একই সঙ্গে সামাজিক দোষত্রুটি যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও মহিলাদের প্রতি যে অসদাচরণ করা হয়, তা নিয়েও আলোকপাত করেছেন।
নিজ প্রতিষ্ঠান 'বায়্যিনাহ'র মাধ্যমে উস্তাদ নোমান আলী খান একটি চমৎকার উদাহরণ পেশ করেছেন। তিনি 'বায়্যিনাহ'র মাধ্যমে দেখিয়েছেন, কীভাবে মুসলিম চিন্তাবিদরা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের কথাগুলোকে পৌঁছে দিতে পারেন এবং আধুনিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে সব ধরনের মানুষের কাছে যেতে পারেন।
আমরা আশা করছি, এই লেখাগুলো মুসলিম জাতিকে আলোর উৎসরেখার সন্ধান এনে দেবে, মুসলমান হৃদয়ে নতুন একধরনের উৎসাহ তৈরি করবে। নিজেদের আত্মিক উন্নয়নের সাথে সাথে বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব পালন এবং ঈমানদীপ্ত চেতনায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও ঢেলে সাজাতে সহায়তা করবে।